ভারতের দ্বারস্থ ইউক্রেন, মোদি-পুতিন কথা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সূত্রে খবর, প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে ইউক্রেনে থাকা ভারতীয় পড়ুয়া-সহ অন্য নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আবেদন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। একইসঙ্গে সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের আবেদন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

More than 250 students returned from Ukraine after Indian embassy in Kyiv urged the Indian students studying in Ukraine to leave the country temporarily amid crisis on the Ukraine-Russia borders.

Indian students returning from Ukraine are received by their relatives amid the crisis, at Indira Gandhi International airport in New Delhi, India, 22/02/2022. Source: AAP image/EPA/RAJAT GUPTA

ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অবগত করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। আরও জানা গিয়েছে যে, যুদ্ধ থামিয়ে ন্যাটো সামরিক জোটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।

এর আগে বৃহস্পতিবার, রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করতেই কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ওই বৈঠকের পর খানিক পরেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কথা হয় বলে জানা গিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানিয়েছে, শুরুতেই রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট বর্তমানে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে, তা প্রধানমন্ত্রী মোদীকে বিস্তারিত জানান পুতিন। এর পরেই মোদী বলেছেন, রাশিয়া এবং ন্যাটো গোষ্ঠীর মধ্যে মতভেদ সুস্থ আলোচনার মধ্যে সমাধান করা সম্ভব। তবে তার আগে হিংসা থামানোর আর্জি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি পুতিনকে বলেছেন, সমস্যার সমাধানে সব পক্ষকেই আগে উদ্যোগ নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার পরিসর তৈরি করতে হবে।

এর মধ্যে আবার রাশিয়ার হামলা আটকাতে ভারতের দ্বারস্থ হয়েছে ইউক্রেন। বৃহস্পতিবার নয়া দিল্লিতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ইগর পোলিখা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে শান্তি ফেরাতে মধ্যস্থতা করার আবেদন জানিয়েছেন। অবিলম্বে শান্তি আলোচনা চালাতে যুযুধান দু’দেশের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে যোগাযোগ করার অনুরোধও করেছেন তিনি।

ইগর পোলিখা বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ন্ত্রণে নয়াদিল্লি আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অবিলম্বে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করছেন।

এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ ঘোষণার পরেই ইউক্রেন সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় স্থল এবং আকাশপথে হামলা করছে রুশ বাহিনী। রাজধানী কিভে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রবল চাপের মুখে জেলেনস্কি সরকার ভারতের সাহায্য চেয়েছেন বলে কূটনৈতিকবিদদের ধারণা।
এদিকে, ইউক্রেনে থাকা ভারতীয়দের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সেখানকার ভারতীয় দূতাবাস। রাশিয়ার হামলার কারণেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইউক্রেনের আকাশসীমা। ফলে এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে আটকে রয়েছেন বহু ভারতীয়। আর তাদের উদ্ধার করার জন্য ইতিমধ্যেই বিকল্প পথের চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে সরকার। সূত্রের খবর, বিদেশমন্ত্রকে উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক করা হয়েছে। সেখানে ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতীয়দের বিকল্প পথে উদ্ধার করে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ইউক্রেনে ভারতীয় দূতাবাসের তরফে যে সমস্ত ভারতীয় কিভ যাচ্ছেন, বিশেষত, যারা কিয়েভের পশ্চিম অংশ থেকে যাতায়াত করছেন, তাদের অস্থায়ীভাবে নিজেদের শহরে ফিরে আসতে বলা হয়েছে। পশ্চিমের সীমান্তবর্তী দেশগুলিতে সুরক্ষিত জায়গায় তাদের আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।

দূতাবাসের তরফে বলা হয়েছে, বর্তমানে ইউক্রেনের পরিস্থিতি অত্যন্ত অনিশ্চিত। ভারতীয়রা যে যেখানেই আছেন, তাদেরকে শান্ত এবং সুরক্ষিত কোনও জায়গায় আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে, রুশ হামলায় ইউক্রেনের কিভে আটকে পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের স্বাগতা সাঁধুখা, অর্ঘ্য মাজিরা। কলকাতা লাগোয়া গোবরডাঙার বাসিন্দা স্বাগতা সাধুখাঁ, সুন্দরবনের কাছে রায়দিঘির বাসিন্দা অর্ঘ্য মাজি কিভে এমবিবিএস পড়তে গিয়েছেন। ভোর রাতেই বোমার আওয়াজে ঘুম ভেঙেছে তাঁদের। তখনই জানতে পারেন রুশ হামলার কথা, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনটাই জানিয়েছেন তারা। ইউক্রেনে উড়ান পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আপাতত দেশে ফেরার উপায় নেই। বাড়ির ছেলে-মেয়ে আটকে পড়ায় উদ্বেগে স্বাগতা, অর্ঘ্য-র পরিবার।

এক ভিডিও বার্তায় স্বাগতা সাধুখাঁ জানিয়েছেন জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর শোনা গিয়েছিল বোমা বর্ষণ হবে। কিন্তু, এটা যে হঠাৎ করে হবে তা বোঝা যায় নি। ইউক্রেনের সরকার অবশ্য সবাইকে বাড়ির ভিতরে থাকতে বলেছে। পর্যাপ্ত জল, খাবার মজুত রাখতে বলেছে। তবে হামলা জোরদার হলে তাঁদেরকে পশ্চিমের কোনও একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এই অবস্থায়, যুদ্ধ পরিস্থিতির জেরে ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয়দের নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁদের উদ্দেশে ইউক্রেনের ভারতীয় দূতাবাসের পরামর্শ, পরিস্থিতি ঘোরালো হলে গুগল ম্যাপ দেখে কাছেপিঠের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ইউক্রেনের ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশনগুলি বোমা হামলা থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে সদ্য জারি হওয়া নির্দেশিকায়।

রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করার পরেই আকাশপথ বন্ধ করে দেয় ইউক্রেন। যার জেরে ইউক্রেনে আটকে পড়ার ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সূত্রেই খবর, ইউক্রেনে এখনও অন্তত ১৮ হাজার ভারতীয় আটকে রয়েছেন। তাঁদের জন্যই ইউক্রেনের ভারতীয় দূতাবাস থেকে তৃতীয় নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।
এদিকে ইউক্রেনে আটকে থাকা প্রায় ২০ হাজার ভারতীয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতিসংঘে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নয়া দিল্লি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি বলেছেন, দু’দিন আগে নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠক করেছিল এবং পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছিল। সেখানে তাঁরা দ্রুত উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কিত সমস্ত সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকরী ও যুক্তিগ্রাহ্য কূটনীতির উপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছেন, উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সাম্প্রতিক উদ্যোগে সাড়া পাওয়া যায় নি। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলি সেই আহ্বানে কর্ণপাত করা হয় নি।পরিস্থিতি একটি বড় সঙ্কটে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেখানে থেকে যাওয়া প্রায় ২০ হাজার ভারতীয়র নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টি এস তিরুমূর্তি।

আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে ভারতের সাধারণ নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে। ভারতে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব-অর্থনীতিতে প্রবল প্রভাব পড়বে। দাম বাড়তে পারে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে গম বিভিন্ন সামগ্রীর। অপরিশোধিত তেলের দামও বাড়তে পারে যা জিডিপিতে বড় প্রভাব ফেলবে। দাম বাড়তে পারে এলপিজি এবং কেরোসিনের। দাম বাড়তে পারে পেট্রল, ডিজেলেরও।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের পরিস্থিতির জন্য কৃষ্ণ সাগর থেকে যদি শস্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে খাদ্যশস্যের দাম তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। গম রপ্তানিকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া। সেখানে ইউক্রেন চতুর্থ স্থানে। বিশ্বে গমের রপ্তানির ক্ষেত্রে চার ভাগের এক ভাগ গম রপ্তানি হয় এই দুই দেশ থেকে। দু’ দেশের যুদ্ধের প্রভাবে প্যালাডিয়াম ধাতুর দাম বাড়তে পারে। অটোমোটিভ এক্সহস্ট সিস্টেম এবং মোবাইল ফোনে এই ধাতু ব্যবহার করা হয়। রাশিয়ার উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারির সম্ভাবনার মধ্যেই সম্প্রতি এই ধাতুর দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে বাড়তে পারে মাইক্রোচিপের দামও।

যুদ্ধ আবহে ভারতকে পাশে চাইল আমেরিকা

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতকে পাশে চেয়েছে আমেরিকা। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ফোন করেছিলেন মার্কিন বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।

আমেরিকার বিদেশ দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস জানিয়েছেন, রাশিয়া যেভাবে বিনা প্ররোচনায় অন্যায়ভাবে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে, একসঙ্গে তার প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন বিদেশসচিব।

অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন নিজেও এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে, সেটা আন্তর্জাতিক সীমা নিয়মের অবমাননা। যৌথভাবে এর প্রতিবাদ করা নিয়ে ভারতের বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।

বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও টুইটে মার্কিন বিদেশ সচিবের সঙ্গে আলোচনার কথা স্বীকার করেছেন। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের এই ফোনের আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রাশিয়ার মোকাবিলায় ভারতকে তিনি পাশে চান। হোয়াইট হাউসে এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ করার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে আমেরিকা।

এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: 

আমাদেরকে অনুসরণ করুন 

Follow SBS Bangla on .

Share
Published 25 February 2022 4:15pm
Updated 2 March 2022 10:50am
By Partha Mukhopadhyay

Share this with family and friends