ডার্ক স্কাই ট্যুরিজমের ইতিবৃত্ত: অস্ট্রেলিয়ায় নক্ষত্রদর্শন

Milky Way over the Karlu Karlu/Devils Marbles Conservation Reserve, NT

Milky Way over the Karlu Karlu Source: Getty Images/John White Photos

চলুন আপনাদের নিয়ে যাই মহাশূন্যে, নক্ষত্রের রাজ্যে। নক্ষত্রের গায়ে গায়ে লেখা রুপকথারা কিভাবে আবার প্রান ফিরে পাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ডার্ক স্কাই ট্যুরিজমের মাধ্যমে — তা জানানো হবে এবারের সেটলমেন্ট গাইড প্রতিবেদনে।


রাতের আকাশে নক্ষত্রের মেলা দেখার আদর্শ স্থান হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। শহরের আলোর ছটায় রাতের তারা আড়ালে চলে যায়। কিন্তু শহর থেকে দূরে কোথাও গিয়ে নক্ষত্রদর্শনের স্থান আর তার অবসর কোথায়?

এদেশে তেমনটা হয় না। শহর থেকে কয়েক ঘন্টা ড্রাইভ করেই আপনি তারা দেখার উৎকৃষ্ট জায়গা পেয়ে যাবেন।

 এখান থেকে অর্থাৎ দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে যেসব তারা দেখা যায়, উত্তর গোলার্ধ থেকে সেসব তারা দেখা যায় না। 

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির কালচারাল এস্ট্রোনমির সহযোগী অধ্যাপক ডুয়েন হামাচার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এদেশে এসে অনেক তারা প্রথম দেখতে পান: ম্যাজেলানিক মেঘের ভাঁজে ভাঁজে থাকা নক্ষত্রগুলো অথবা আকাশগঙ্গা বেয়ে যেসব তারা চলে গেছে সাউদার্ন ক্রস নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে— এমন অনেক তারাই তার আগে কখনো দেখা হয়নি। 

অস্ট্রেলিয়ার পতাকায় যে তারকার প্রতীক আছে, সেই বিখ্যাত সাউদার্ন ক্রস দেখার উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে হেমন্ত আর শীত ঋতু অর্থাৎ এদেশের অটাম আর উইন্টার।
Southern Cross constellation
Southern Cross constellation Source: Getty images/Phil Clark/EyeEm
হীম ঠান্ডা রাতে চাদর থেকে মুখ তুলে আপনি তাকাবেন দক্ষিন-পূর্ব আকাশের দিকে; দেখবেন দিকচক্রবালে পাঁচটি তারার এক টুকরো হীরা যেন অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বল করছে!
রাতের আকাশের এক টুকরো হীরে দেখার মধ্য দিয়ে আপনি নক্ষত্রদর্শন শুরু করে দিতে পারেন। এরপর নক্ষত্রের অভিযানে আপনি আবিস্কার করতে পারবেন সাউদার্ন ক্রসের ঠিক পাশেই দুই টুকরো তারার মেঘ ঝুলে আছে;  ওটার নাম হচ্ছে ম্যাজেলানিক মেঘ। 

গ্যালাক্সিকন্যা নামে খ্যাত ক্যারল রেডফোর্ড এস্ট্রোট্যুরিজম ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। গ্যালাক্সিকন্যা ক্যারল এক অভিযানে নেমেছেন। তিনি অয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডার্ক স্কাই ট্যুরিজম এর প্রসার ঘটাতে চান।

ডার্ক স্কাই ট্যুরিজমকে আমরা অন্ধরাতের আকাশ পর্যটন বলতে পারি। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার আকাশে রাতের তারা দেখার অভিজ্ঞতা সারা জীবনের বা সারা বিশ্বে বিরল।
Under the Milky Way
Under the Milky Way Source: Getty Images/Supoj Buranaprapapong
আমৃত্যু মনে রাখার মত… বা নক্ষত্রে মিলিয়ে যাওয়ার আগে তারা দেখার অভিজ্ঞতা পেতে হলে আপনাকে শহর থেকে দূরে চলে যেতে হবে। বেশিদূর নয়, কয়েক ঘন্টার ড্রাইভই যথেষ্ট। এবার নির্জন আর ঘুটঘুটে অন্ধকার কোথাও  বসে পড়ুন… আর দেখুন লাখো তারার মেলা! 

উল্লেখ্য যে, আর সব শাস্ত্রের মতই জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়টি মানবজাতির হাজার বছরের সঞ্চিত জ্ঞানের আকর। ভাবুন তো, আকাশের কোটি কোটি তারাকে চেনার জন্য কত হাজার বছর, কত শত সভ্যতার পথ পেরিয়েছে মানুষ! 

পশ্চিমাদের মত আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জকে চিনে রাখার পন্থা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও উদ্ভাবন করেছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের  নক্ষত্রের ঠিকুজী জানার পন্থা কিছুটা আলাদা। আদিবাসীদের বিশ্বাস অনুযায়ী,
যা কিছু ডাঙায় আছে, তার সবই আছে আকাশে। আকাশ যেন মাটিরই প্রতিবিম্ব।
রাতের আকাশ যেন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের আধ্যাত্মিক ইমু পাখির বাসা। এই ইমু পাখির মাথাটা পড়েছে বিশাল আকাশগঙ্গা বা মিল্কি ওয়েতে। সূর্যাস্তের সময় ইমু পাখির অবস্থান জানান দেয় — কবে ঋতু বদল হবে, সে অনুযায়ী কখন ইমু পাখি তার ডিম সংগ্রহ করবে। 

উত্তর-পশ্চিম নিউ সাউথ ওয়েলসের গিলার মাইকেল এন্ডারসন একজন 'ওলিয়া' বায়োজ্যোষ্ঠ আদিবাসী অভিভাবক এবং জ্যোতির্বিদ। তিনি এ বিষয়ে বলেন, আদিবাসীরা বিশ্বাস করে আকাশের ইমু পাখি হচ্ছে এদেশের জল আর জলাশয়ের রক্ষক। পানির উপর সব প্রানীর যাতায়াত তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। 
Emu in the Sky
Emu in the Sky Source: Stellarium.org
প্রশ্নাতীতভাবেই ফার্স্ট নেশন বা এদেশের আদিবাসীরাই এখানকার আদি জ্যোতির্বিদ ছিলেন বলে মত প্রকাশ করেন ডুয়েন হ্যামাচার। আদিবাসীরাই এদেশে হাজার বছর আগে মানববসতি গড়েছিল। জ্যোতিষশাস্ত্রে ন্যুনতম জ্ঞান না থাকলে নিশ্চয় এদেশে তারা পৌঁছাতেই পারতেন না। 

ডার্ক স্কাই ট্যুরিজমের মাধ্যমে পশ্চিমা জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানভান্ডার খুলে যাচ্ছে, পাশাপাশি মানুষ ফার্স্ট নেশন জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত জ্ঞানের বিষয়েও জানতে পারছে। মহাবিশ্বকে জানার হাজার বছরের প্রয়াস আদিবাসী ধ্যান ধারণা থেকে জানা যায়। 

আকাশের তারার সাথে আদিবাসী জীবনধারা আর পরিবেশ যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা রাতের আকাশের তারার সাথে তাদের আধ্যাত্ম ও বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। 

ক্রমবর্ধমান নগরায়নের সাথে সাথে পরিবেশদূষণ আর  আলোকদূষণ বেড়ে চলেছে। রাতের আকাশ আর আগের মত অন্ধকার নয়, আকাশের রূপকথারা যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

রাতের আকাশকে অন্ধকার রাখতে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া সরকারের সাথে একযোগে করে যাচ্ছেন গ্যালাক্সিকন্যা ক্যারল রেডফোর্ড। তিনি জানান, আলোকদূষণ প্রতিবছর দুই শতাংশ হারে বাড়ছে।
The sky above Spoonbill Lake, Chittering, one hour north of Perth
The sky above Spoonbill Lake, Chittering, one hour north of Perth Source: Astrotourism WA
গ্যালাক্সিকন্যা রাতের আকাশে লুকিয়ে থাকা সব রূপকথা আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান। 

তিনি বর্তমানে এবরিজিনাল এস্ট্রোনমি ট্যুরিজম ট্রেইল বা আদিবাসী জ্যোতির্বিদ্যা পর্যটনের একটি কার্যক্রম গড়ে তুলতে সহায়তা করছেন। এর মাধ্যমে মানুষ আদিবাসী বায়োজ্যোষ্ঠদের কাছ থেকে তাদের জ্যোতির্বিদ্যা জানার সুযোগ পাবে। 

এ বিষয়ে নিউ সাউথ ওয়েলসের মিস্টার গিলার বলেন, ডার্ক স্কাই ট্যুরিস্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা উৎসাহি দর্শনার্থীদেরকে নক্ষত্রের সাথে জড়িত আমাদের উপকথা আর লোকাচারের পরিচয় করিয়ে দেই।

প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।

এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: 

আমাদেরকে অনুসরণ করুন 

Share