স্কুল পরীক্ষায় অনেক ভালো রেজাল্ট করেও ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারছে না শরণার্থী ভিসায় থাকা দুই বোন

The quadrangle at the University of Sydney

The quadrangle at the University of Sydney Source: AAP

যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তান এবং সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে আসা দুই বোন বাতুল ও ফাতেমা অস্ট্রেলিয়ার একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডভান্সড মেডিকেল সায়েন্স পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের সেফ হ্যাভেন এন্টারপ্রাইজ ভিসা। শরণার্থী ভিসায় থাকা বাতুল ও ফাতেমার আশা-নিরাশার গল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন।


গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো

  • মিস বাতুল ও ফাতেমা দুজনেই যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তান এবং সিরিয়া থেকে ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন।
  • এটি একটি 'অলৌকিক ব্যাপার' যে তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন একটি পুরোনো ভাঙাচোরা নৌকায় করে। 
  • তাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের শরণার্থী ভিসা।
আট বছর অস্ট্রেলিয়ায় থাকার পরে, দুবোনই বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডভান্সড মেডিকেল সায়েন্স পড়ার সুযোগ পেয়েছেন।

তবে তাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের শরণার্থী ভিসা। সেফ হ্যাভেন এন্টারপ্রাইজ বা এসএইচইভি ভিসাধারী এই শিক্ষার্থীদের তাদের ভিসা শর্তের কারণে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসাবে এই কোর্সের জন্য টিউশন ফী দিতে হবে।

ইরাক ও সিরিয়ায় নিপীড়নের আশঙ্কায় যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা আট সদস্যের একটি পরিবারের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় প্রার্থনা করার বিষয়টি ছিল একটি দীর্ঘ এবং সবচেয়ে কঠিন ভ্রমণ।
মালয়েশিয়ার সীমান্তে পুলিশ যখন তাদের পরিবাররকে বিভক্ত করে ফেলেছিল তখন তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল।

বাতুল মোহামাদ হুসেন ও তার পরিবার যে পরিস্থিতি দেখেছিলেন তা বর্ণনা করে বলেন, "আমাদের কোথাও পালিয়ে যেতে হতো, তাই সিরিয়া থেকে ইরান হয়ে থাইল্যান্ডে আসতে হয়েছিল। আমরা যখন থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করলাম তখন আমাদের চারজন সেখানে আলাদা হয়ে গেল এবং আমার বাবা-মা এবং আমার দুই ভাই, পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। তাদের কী হয়েছিল তা আমরা জানতাম না তাই আমরা আমাদের যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এরপর আমরা মালয়েশিয়া ছেড়ে ইন্দোনেশিয়ায় চলে গেলাম, এবং সেখান থেকে একটি নৌকো নিয়ে ক্রিসমাস দ্বীপে পৌঁছলাম।"

তিন বোন এবং ভাই তাদের পরিবারের অন্য নিখোঁজ সদস্যদের ভাগ্য সম্পর্কে অবগত না হতে পারেননি, তারা অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা চালিয়ে যান।

এটি ২০১৩ সালের ঘটনা ছিল। বাতুল এখন ২৬ বছর বয়সী, তিনি বলেন যে এটি একটি অলৌকিক ব্যাপার যে তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন একটি পুরোনো ভাঙাচোরা নৌকায় করে।

“আমরা যে নৌকাটি করে পাড়ি দিয়েছি, সেটি ছিল পুরোনো ভাঙাচোরা। আমি জানি না আমরা কীভাবে সেই সুবিশাল সমুদ্র এবং জলের মধ্য দিয়ে এসেছি, আমি এটি কল্পনাও করতে পারি না। এটি একটি অলৌকিক ঘটনা যে আমরা বেঁচে রইলাম। ”

বাতুল, তার বোন ফাতিমা এবং ভাই মোস্তফা এখন সেফ হ্যাভেন এন্টারপ্রাইজ ভিসা (এসএইচইভি) নামে একটি অস্থায়ী ভিসায় থাকেন, এই ভিসায় তাদের সরকারী সহায়তা সীমাবদ্ধ।

অস্ট্রেলিয়ায় তারা নতুন জীবনে প্রবেশ করেছেন এবং তাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা আয়ারল্যান্ডে পুনর্বাসিত হয়েছেন। এদিকে দুই বোন একটি অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন, তারা ইতিমধ্যেই হায়ার স্কুল সার্টিফিকেট বা এইচএসসি পাশ করেছেন।

বাতুলের ফাইনাল পরীক্ষায় এটার স্কোর ছিল ৮৭.৩৫।

তবে উভয় বোনই ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডভান্সড মেডিকেল সায়েন্স পড়ার অফার পেলেও তাদের স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পড়ার খরচ যা তারা দিতে অক্ষম।
আট বছর অস্ট্রেলিয়ায় থাকার পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন না করা পর্যন্ত এই বোনরা জানতেন না যে তারা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসাবে পড়ছেন।

তাদের ভিসার শর্তে তারা এইচইসিএস বা হায়ার এডুকেশন কন্ট্রিবিউশন স্কিম থেকে লোন পাবার যোগ্য নন। এর মানে তাদের পড়াশোনার একমাত্র উপায় হল যদি তারা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মত প্রায় একশ হাজার ডলার ফী দিতে পারেন, যা কোন বোনই এই ব্যয় বহন করতে পারবে না।

বাতুলের সাথে থাকেন তার বড় বোন ফাতিমা এবং পড়াশোনা করে।

তিনি বলেন যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্বপ্নটি ভেঙে গেছে।

তিনি বলেন, "তিন বছর ধরে, আমি একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য নিজেকে এত কঠোরভাবে প্রস্তুত করেছিলাম, যা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।"

হোস্ট ইন্টারন্যাশনালের সিইও ডেভিড কিগান তাদের ভিসার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, "বাতুল এবং ফাতিমা যে সেফ হভেন এন্টারপ্রাইজ ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায় আছেন তা একটি টেম্পোরারি প্রটেকশন ভিসা, এটি পাঁচ বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হিসাবে বসবাসের অনুমতি দেয়, যার অর্ধেক সময় রিজিওনাল এলাকায় থাকতে হবে। এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যার প্রধানটি হল আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য লোন পাবেন না।"

২০১৪ সালের শেষের দিকে, অ্যাবট সরকার অস্থায়ী ভিসা টি-পি-ভি এবং এস-এইচ-ই-ভি চালু করেছিল যাতে মানুষ নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়ায় আসতে নিরুৎসাহিত হয়।

ডেভিড কিগান ব্যাখ্যা করে বলেন, “এই ভিসা নৌকায় করে আসা মানুষদের থামানোর চেষ্টা করেছে। আর তাই তাদের নিরুৎসাহিত করতে স্থায়ী শরণার্থী ভিসার পরিবর্তে এই ভিসা দেয়া হয়।”

প্রায় ৩০,০০০ আশ্রয়প্রার্থী যারা ১৩ ই আগস্ট ২০১২ থেকে ১ জানুয়ারী ২০১৪ সালের মধ্যে এসেছেন তাদের অফশোর ডিটেনশনে দেয়া হয়নি।

এই গ্রূপটি আইনী সহায়তা এবং ইনকাম সাপোর্ট পায় না এবং অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

এই বোনরা বলেন যে তারা আফগানিস্তান এবং তারপর সিরিয়া থেকে পালিয়েছিল কারণ তাদের কোনও বিকল্প ছিল না।

ফাতেমা বলেন, "আট বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে, আমি আমার মাকে দেখিনি। এটি বেদনাদায়ক।"

বাতুল বলেন, "যদি আমাদের একটি নিরাপদ বাড়ি থাকত, তবে আমরা আমাদের দেশ ছেড়ে আসতাম না।"

বাতুল মনে করেন যে হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থী আছেন যারা শিক্ষিত এবং যোগ্য এবং অস্ট্রেলিয়ান সমাজে অবদান রাখতে চান।

তিনি বলেন যে তিনি তাদের পক্ষেও কথা বলেছেন।

তিনি বলেন, "আমি জানি এমন হাজারো লোক আছেন যারা অস্ট্রেলিয়ায় নিরাপদে থাকতে এবং কাজ করা এবং পড়াশোনার সুযোগ পেতে অবৈধভাবে এসেছিলেন। তারা একটি স্বাভাবিক জীবন চান, কেবলই একটি স্বাভাবিক জীবন।"

এসবিএসকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স বলেছে;

"টিপিভি এবং এস-এইচ-ই-ভি ভিসা যারা পেয়েছে তারা সরকারী অর্থায়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তে পারবেন। তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তারা বিদেশী শিক্ষার্থী হিসাবে বিবেচিত হবে। হেক্স বা হেল্প প্রোগ্রামের ফান্ডিং শুধু অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক এবং কিছু স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।"

তবে এস-এইচ-ই-ভি ভিসা থেকে পার্মানেন্ট ভিসা পাবার পথটি পরিষ্কার নয়। ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স বলেছে এখনো পর্যন্ত কোনও ব্যক্তি এস-এইচ-ই-ভি থেকে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি পায়নি।

তবে বিবৃতিটি নিশ্চিত করেছে যে "বেশ কিছু এস-এইচ-ই-ভি ভিসাধারী নির্ধারিত ভিসার জন্য শর্ত পূরণ করেছেন এবং তারা ভিসার বৈধ আবেদন করতে সক্ষম হবেন।"

তবে বাতুল এবং ফাতেমার জন্য এটি কী কাজে লাগবে তা অজানা রয়ে গেলো।
তবে এই বোনরা এখনো আশাবাদী।

পুরো প্রতিবেদনটি বাংলায় শুনতে ওপরের অডিও প্লেয়ারে ক্লিক করুন

আরো দেখুন:




Share