ওয়েস্টার্ন সিডনিতে নিহত আর্নিমার মায়ের আকুতি: “মেয়েটারে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না, এর বিচার চাই ভাই”

Arnima Hayat’s parents have remembered their daughter as “honest, polite and gentle”.

Arnima Hayat’s parents have remembered their daughter as “honest, polite and gentle”. Source: Guardian/Seven News

সিডনির নর্থ প্যারামাটায় অস্বাভাবিকভাবে মারা যাওয়া আর্নিমা হায়াতের বাবা-মা, চাচা ও ক্যান্টারবেরি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ শাহে জামান টিটু কথা বলেছেন এসবিএস বাংলার সঙ্গে।


সতর্কতা: এই নিবন্ধে পারিবারিক সহিংসতার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।


হাইলাইটস

  • ওয়েস্টার্ন সিডনির একটি অ্যাপার্টমেন্টে রাসায়নিক পদার্থ ভর্তি বাথটাবে আর্নিমা হায়াতের মৃতদেহ পাওয়া যায় ৩০ জানুয়ারি, ২০২২।
  • তার পার্টনার মেরাজ জাফরের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনেছে পুলিস।
  • আর্নিমার বাবা-মা তাকে সৎ, নম্র ও ভদ্র হিসেবে স্মরণ করেন।

সিডনির নর্থ প্যারামাটার পেনান্ট হিলস রোডের একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ৩০ জানুয়ারি, ২০২২, রবিবার বিকাল সাড়ে চারটার দিকে আর্নিমা হায়াত নামের ১৯ বছর বয়সী এক তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিস।

পরবর্তিতে জানা যায়, তিনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এবং তার বাবার নাম আবু হায়াৎ।

এরপর, তার পার্টনার, ২০ বছর বয়সী মেরাজ জাফরের খোঁজ করে পুলিস। মেরাজ ব্যাংকসটাউন পুলিস স্টেশনে যান এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগও আনা হয়।
তাকে জামিন দেওয়া হয় নি। ১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার ব্যাংকসটাউন লোকাল কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট শেন ম্যাকঅ্যানাল্টির সামনেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিংবা অডিও-ভিজুয়াল লিংকের মাধ্যমে হাজির হন নি।

আদালতের নথি অনুসারে, মিস্টার জাফর মিজ হায়াৎকে শনি ও রবিবারের মাঝে নর্থ প্যারামাটায় হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

৫ এপ্রিল আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

আর্নিমা হায়াতের বাবা আবু হায়াৎ এসবিএস বাংলাকে বলেন,

“আমার মেয়েটারে মারছে, আমরা কীভাবে ভাল থাকি ভাই? আমরা অনেক শক খেয়েছি। আমার জীবনে আমি বড় ধরনের লুজ করে ফেলেছি। মেয়েটারে তিলে তিলে গড়ছি। তারে ডাক্তার বানাইছি।”

ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিনে সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো আর্নিমা, বলেন তিনি।

২০০৬ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। মেয়ে ও স্ত্রীকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসেন ২০১২ সালের অক্টোবরে।

“আর্নিমার বয়স তখন ৯-১০ বছর ছিল। ইয়ার ফোরে পড়তো।”
ছোটবেলায় আর্নিমা খুব ভাল ও মেধাবী ছিল, বলেন তিনি।

“ছোটবেলায় আর্নিমা খুবই ভাল ছিল। সবসময়ই সে ভাল ছিল। খুবই ভাল ছিল। খুব মেধাবী। তারপর অনেস্ট এবং খুব ভদ্র ছিল, জেন্টেল ছিল। দুস্টুমিও খুব কম করতো এবং আমাদের প্রতি ওর খুব ভালবাসা ছিল। ভালবাসা বলতে আমি, যখন আমি ওকে রেখে আমি বাংলাদেশে, তখন খালি আমারে ফোন দিত, ‘বাবা, তুমি আমারে কবে অস্ট্রেলিয়ায় নিবা? বাবা, তুমি কবে অস্ট্রেলিয়ায় নিবা?’ আমি বলি, ‘মা, আমি তোরে খুব তাড়াতাড়িই নিব, তোর মায়েরে আর তোরে। খুব তাড়াতাড়িই নিব। আমি দেখি টেম্পোরারি রেসিডেন্সিটা হয় কিনা। আমি তোরে নিব।’ যখন আমি টেম্পোরারি রেসিডেন্ট হইছি তখন তাদের নিয়া আসছি।”

আর্নিমার লাশ কবে নাগাদ দাফন করা হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বুধবার তাদের ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে গেছে ডিটেক্টিভ পুলিস।

“আর্নিমার লাশ মূলত, ওর বডিটা স্পয়েল হয়ে গেছে। স্পয়েল বলতে ওর বডিটা আইডেন্টিফাই করতে পারতেছে না। এই জন্য (গত)কালকে (বুধবার) ডিটেক্টিভ পুলিশ আমাদেরকে, আমার আর ওয়াইফের ডিএনএ নিয়ে গেছে এবং ডিএনএ টেস্টটা যখন কমপ্লিট হবে তখন তারা এই বডিটা রিলিজ করবে। এবং আমরা রুকউড-এ কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করছি এবং আমরা লাকেম্বা বড় মসজিদে, তাদের সাথে আমরা অলরেডি কথা বলছি। যখন লাশ আসবে, ওরাই টোটাল ব্যাপারটা অর্গানাইজ করবে।”

আর্নিমা হায়াতের মা মাহফুজা হায়াৎ খুব কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি তার মেয়ের হত্যার বিচার চান। তিনি বলেন,

“আমার মেয়েরে যেমনে মারছে আমি সেভাবে .... আমার মেয়েরে যেভাবে কস্ট দিয়া মারছে ভাই, আমি তো কথা কইতে পারি না।”

“আমি কোনো কথা শুনতে পারি না। আমার কস্টে বুকটা ফাইট্টা যায়। আমি মেয়েটারে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না। এর বিচার চাই ভাই।”
আর্নিমার মৃতদেহ রাসায়নিক পদার্থে ভর্তি একটি বাথটাবে পাওয়া গেছে। এ বিষয়টিও কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না তার মা মাহফুজা হায়াৎ। তিনি বলেন,

“মারছে, মারছে, আমার মেয়েটারে এসিড কেন দিল?”

“আমার অস্ট্রেলিয়ায় কেন আসা হইছে আমার মেয়েটারে নিয়া? আমার মেয়ে তো বাংলাদেশে খুব ভাল ছিল। কেন আমি অস্ট্রেলিয়ায় এসে আমার মেয়েটারে হারাইলাম?”

আর্নিমার চাচা আবু সালেহ শেখ পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। তিনি বলেন,

“আমি আর্নিমার বড় কাকা। আর্নিমার আব্বুর ছোট ভাই আমি।”

“আর্নিমা খুবই ভাল ছিল। এক কথায়, মেধাবী এবং সবসময় ওর মুখে হাসি থাকতো এবং কাকা হিসেবে খুবই শ্রদ্ধা করতো (আমাকে) এবং আমি ভাতিজি হিসেবে খুবই গর্ববোধ করতাম (তাকে নিয়ে) এবং সবসময় ওকে ভালবাসতাম, স্নেহ করতাম। এক কথায়, অসাধারণ।”

আর্নিমার বাবা-মায়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন,

“তারা মেন্টালি খুবই সিক। কারণ, এ রকম মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। তো, এজন্য তারা আমার বাসায় আছে।”

“গত রবিবার থেকেই, যখন পুলিশ ডেডবডি সনাক্ত করে, তখন থেকেই তারা আমার বাসায় আছে। মেন্টাল সাপোর্ট হিসেবে আমি যতটুকু পারতেছি তাদের সাথে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করতেছি। বাট, তারা তো, বোঝেনই, এ রকম মৃত্যুতে খুবই শোকাহত। খুবই তাদের অবস্থা খারাপ। খাওয়া-দাওয়া ওরকমভাবে করতে পারতেছে না। প্রথম দু’দিন কিছুই খায় নাই। পানি পর্যন্ত খাওয়াতে পারতেছি না। খুবই অবস্থা খারাপ। এই মৃত্যুর জন্য আর কি। আমিও শকড, খুবই শকড এই মৃত্যুতে।”

আর কারও যেন এ রকম পরিণতি না হয় সেটাই কামনা করেন তিনি।

“আমি সবার উদ্দেশে বলতে চাই যে, এ রকম মৃত্যু যেন নেকস্ট টাইমে আর না হয়।
ক্যান্টারবেরি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ শাহে জামান টিটু আর্নিমার বাবা আবু হায়াৎকে প্রায় ১০ বছর ধরে চিনেন। তিনি বলেন,

“এখানে লাকেম্বাতেই উনার বিজনেস। উনি এখানে দীর্ঘ দিন আছেন। সেই সুবাদে আমার সাথে উনার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।”

“যেহেতু এই এলাকায় আমার বিজনেস এবং আমি এই এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি ছিলাম। সেই হিসেবে আমি এই এলাকার কম-বেশি সবাইকেই চিনি। যতটুকু দেখেছি, খুবই একটি উৎফুল্ল এবং ভাল মেয়ে এবং শান্তশিষ্ট মেয়ে দেখেছি। এবং সবসময় দেখেছি সেটাই যে, সে স্বাভাবিকভাবে আমার দোকানে আসতো এবং ... একটি উৎফুল্ল মেয়ে দেখেছি তাকে।”

আর্নিমার বাবা-মায়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন,

“এতবড় একটা দুর্ঘটনার পর একটা পরিবার কীভাবে স্বাভাবিক থাকে? তারা শোকাহত এবং অত্যন্ত আপসেট।”

শোকগ্রস্ত এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন,

“দেখেন, আমাদের হাতে তো কিছু নাই, সবকিছুই তো ল অ্যান্ড অর্ডারের হাতে এদেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলে। তবে, আমরা সামাজিক জীব। সামাজিকভাবে যেভাবে বসবাস করি, সে হিসেবে পরিবারে গিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া, মানসিকভাবে সান্ত্বনা দেওয়া, পাশাপাশি তাদের সাথে থেকে এই পুরা প্রসিডিউরটাকে যেন স্মুথলি হয়, সেই দিক দিয়ে আমরা খেয়াল রাখতেছি; যাতে লাশটা দাফন ঠিক মতো করে দেওয়া যায়, সেভাবে পারিবারিক সাপোর্ট দেওয়া যায়, মেন্টালি যাতে, সামাজিকভাবে আমরা সাপোর্ট দিতে পারি সেই চেষ্টা করছি।”
NSW Police officers at the scene where a woman was found dead inside an apartment at North Parramatta, Sydney, 31 January, 2022.
NSW Police officers at the scene where a woman was found dead inside an apartment at North Parramatta, Sydney, 31 January, 2022. Source: AAP
পরিশেষে, এই ঘটনার প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন,

“এই ধরনের যে কাজ করা হয়েছে সমাজে, এটা জঘন্যতম একটা অপরাধ, ন্যক্কারজনক একটা অপরাধ। আমি জানি যে, অস্ট্রেলিয়ার ল অ্যান্ড অর্ডার খুবই ন্যায়-সম্মত, তো আমি মনে করি এটা জাস্টিস পাবে এই পরিবার।”

নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে:

এই ঘটনা সম্পর্কে যদি কারও কোনো কিছু জানা থাকে, তাহলে ক্রাইম স্টপার্স এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ফোন: 1800 333 000 কিংবা ঠিকানায়। এক্ষেত্রে কঠোরভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে। আরও বলা হচ্ছে, নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিস-এর সোশাল মিডিয়া পেজের মাধ্যমে যেন কোনো রিপোর্ট করা না হয়।

প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।


আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ যদি পারিবারিক এবং ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হন, তাহলে 1800RESPECT বা 1800 737 732 নম্বরে কল করুন বা 1800RESPECT.org.au-এর ওয়েবসাইট দেখুন। জরুরি প্রয়োজনে 000 নম্বরে কল করুন।

If you or someone you know is impacted by family and domestic violence, call 1800RESPECT on 1800 737 732 or visit . In an emergency, call 000.

Follow SBS Bangla on .


এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: 

আমাদেরকে অনুসরণ করুন 

Share